লড়াকু জান্নাত সবাইকে ‘তাক লাগিয়ে দিয়েছে’, এখন তার দরকার পরিবার

জান্নাতকে তার নাম ধরে বা ‘বাবা’ বলে ডাকলেই মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে। আর সেই হাসিতেই চিকিৎসক ও নার্সেরা তাঁদের সব কষ্টের কথা ভুলে যান। এই জান্নাতকে পলিথিনে ভরে কেউ ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল। শুধু তা–ই নয়, ফেলে দেওয়ার আগে তার মাথায় ইট বা পাথর দিয়ে আঘাতও করা হয়েছিল।

গত ১৪ মার্চ থেকে শিশুটি ঢাকার মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে আছে। এর আগের রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের একটি ডাস্টবিন থেকে নবজাতকটিকে উদ্ধার করেছিল একটি পরিবার।

মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (এনআইসিইউ) প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান নবজাতকটির নাম দিয়েছেন জান্নাত। তাঁর তত্ত্বাবধানেই আছে শিশুটি। প্রথম দিকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অন্য মায়েদের বুকের দুধ খাওয়ানো হয়েছে জান্নাতকে। এখন সে বড় হচ্ছে, খাবারের চাহিদা বেড়েছে, তাই বাইরে থেকে কেনা কৌটার দুধ দিতে হচ্ছে।

জান্নাত এখন সুস্থ। কিন্তু অন্য কোথাও রাখা সম্ভব নয় বলে এখানকারই একটি শয্যায় তাকে রাখতে হচ্ছে। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্তরাই জান্নাতকে গোসল করানো, খাওয়ানোসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করছেন।

আজ সোমবার চিকিৎসক মো. মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জান্নাতকে যখন প্রথম পাই, তখন তার শরীরের তাপমাত্রা ৯৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের চেয়েও কম ছিল। শ্বাস নিচ্ছে কি নিচ্ছে না, তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখতে হয় ১০ দিন। এর মধ্যে রক্তে জীবাণু পাওয়া যায়। মারাত্মক নিউমোনিয়া হয়। সব মিলে একেকবার ভেবেই নিয়েছিলাম এই বোধ হয় সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে লড়াকু জান্নাত সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।’

 উদ্ধারের পর জান্নাতকে হাসপাতালে ১০ দিন লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়

উদ্ধারের পর জান্নাতকে হাসপাতালে ১০ দিন লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়ছবি সংগৃহীত

মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘জান্নাত যখন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে, তখন মনে হয় জীবনে আর কিছু চাইবার নেই। মায়া ভরা হাসিতে সে সবার মন জয় করেছে। কিন্তু আমরা আর কয় দিন রাখব? এখন দিনে জান্নাতের খাবারসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা খরচ হচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছু সহায়তা করছি।

এনআইসিইউতে দায়িত্বপ্রাপ্তরা সহায়তা করছেন। কিন্তু এখন আসলে জান্নাতের জন্য একটি পরিবার, মা–বাবা জরুরি হয়ে পড়েছে। মা–বাবার আদর পেলে জান্নাত আরও ভালো থাকবে।’

ডাস্টবিন থেকে জান্নাতকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন রোকেয়া নামের একজন নারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, (১৩ মার্চ) রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাঁর এক ভাই প্রথমে ডাস্টবিনে বাচ্চার কান্না শুনতে পেয়ে খবর দেন। তারপর তিনিসহ অন্যরা গিয়ে নবজাতকটিকে পলিথিনের ব্যাগ থেকে বের করেন। এ সময় তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল।

পাঁচ বছর বয়সী এক সন্তানের মা রোকেয়া বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। এসএসসি পর্যন্ত পড়েছি। টিউশনি করি আর টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করি। আমি আর আমার স্বামী বাচ্চাটারে বাড়িতে আনি। পরিষ্কার করে দুধ কিনে খাওয়াই। রাতটা ছিল আমার কাছেই। পরের দিন এলাকার চেয়ারম্যানের মাধ্যমে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। তারপর অন্য হাসপাতালে পাঠাইছে শুনছি।’ সামর্থ্য থাকলে বাচ্চাটিকে নিজের কাছেই রাখতেন জানিয়ে রোকেয়া বলেন, শুনেছেন এমন বাচ্চাদের আদালতের মাধ্যমে কোনো পরিবারের কাছে দেওয়া হয়। তিনি চান, ভালো একটা পরিবারে হেসেখেলে বড় হোক জান্নাত।

জান্নাতকে উদ্ধারের পর স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল হকের মাধ্যমে শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এম এ মান্নানের সহায়তায় ইনস্টিটিউটে জান্নাতকে ভর্তি করা হয়। ফয়সাল হক এখন একটি প্রশিক্ষণে দেশের বাইরে আছেন। বর্তমানে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) কামরুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমদিকে এই নবজাতককে নেওয়ার জন্য বেশ কিছু পরিবার আবেদনও করেছিল। আদালতের মাধ্যমে কোনো পরিবারের কাছে দেওয়া সম্ভব না হলে শিশুটিকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ছোটমণি নিবাসে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। তবে কোনো পরিবারের কাছে দেওয়া গেলে শিশুটি বেশি ভালো থাকবে।

চিকিৎসক মো. মজিবুর রহমান জানালেন,  এ ধরনের নবজাতক উদ্ধারের পর শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর ডাক পড়ে। জান্নাতসহ এ পর্যন্ত উদ্ধার করা মোট ৪৪ নবজাতককে চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি। আদালতের মাধ্যমে বেশির ভাগকেই কোনো না কোনো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, তারা ভালো আছে। কয়েকজনকে সরকারের ছোটমণি নিবাসে পাঠানো হয়েছে।

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে হতাশা প্রকাশ করে মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘জন্মের কয়েক ঘণ্টা বা এক দুই দিন পর নবজাতককে রাস্তার পাশে, ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়া যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। জান্নাতকে শুধু ফেলেই যাওয়া হয়নি, যাতে দ্রুত সে মারা যায় সে জন্য তার মাথায়  আঘাতও করা হয়েছিল। মানুষ কতটা অমানবিক হয়ে গেছে, তার প্রমাণ এটা। জান্নাতের মাথার ঘা শুকাতেই সময় লেগেছে তিন মাস। সেই জান্নাত যখন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে, তখন সব কষ্ট ভুলে যাই। কোনো না কোনো মা–বাবা জান্নাতকে ফেলে গেছেন, এখন ওর জন্য অন্য মা–বাবা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *